"লালু গরুটা" 

বন্ধুরা আজ আপনারেদ জন্য চমৎকার একটি গল্প লিখেছি যার নাম "লালু "তো চলুন পড়ে আশি গল্পটি ৷

ঘুরে ঘুরে গরুটাকে দেখছে কয়েকজন মানুষ। আর দূর থেকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দশ বছরের ছোট মেয়ে ফাতেমা। ফাতেমা ঠিক বুঝতে পারেনা লোক গুলো লালুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কেন ? আর বাবা লোক গুলোর সাথে কী কথা বলছে ? হঠাৎ ফাতেমা লক্ষ্য করে, বাবার হাতে লোক গুলো অনেক গুলো টাকা দিয়েছে। তারপর গরুটিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এইবার ছোট ফাতেমার বুঝতে বাকি থাকেনা বাবা গরুটি বেঁচে দিয়েছেন।
.
দৌড়ে ফাতেমা লালুর কাছে ছুটে যায় কোন কথা না বলেই দড়ি ধরা লোকটার হাতে কামড় বসিয়ে দেয় । ঘটনার আকস্মিকতায় লোকগুলো হকচকিয়ে যায়।
.
- মা, ফাতেমা, এইটা তুমি কি করতাছ?
.
- ওরা আমার লালুরে লইয়া যায় ক্যান ?
.
- ফাতেমা, মা আমার, লালুরে তো বেইচা দিছি, না বেচলে আমরা খামু কি।
.
- আমার খাওন লাগবো না, না খাইয়া থাকু তবুও আমার লালুরে বেঁচতে দিমুনা।
.
মেয়ে গো ধরে বসে আছে, কিন্ত গরু না বেঁচে কোন উপায় নাই, অভাবের সংসারে গরু নিয়ে বসে থাকলে তো হয় না। এতক্ষন জয়নাল মেয়ের সাথে ভালো ব্যাবহারই করেছে এবার একটু রূঢ় আচরণ না করলে মেয়েকে সরানো যাবেনা।
.
- ঘরে যা কইতাছি ফাতেমা, তা না হইলে কিন্তু আমার হাতে মাইর খাবি।
.
- মাইরালাও আমারে তবুও লালুরে বেঁচতে দিমু না
.
এবার সত্যি সত্যি জয়নাল মেয়ের গালে চড় বসিয়ে দেয়। কিন্তু চড় খেয়েও ফাতেমা লালুর গলার রশি হাত থেকে ছাড়েনা । এবার জয়নাল মেয়ের হাত থেকে জোর করে রশি কেড়ে নিয়ে লোক গুলোর হাতে ধরিয়ে দেয় ।
.
- আপনারা যান ভাই, বাচ্চা মানুষ এতকিছু বোঝে না। ছোট কাল থেকে গরুটারে পালছে তো তাই মায়া ধইরা গেছে।
.
লোক গুলো লালুকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে কিন্তু লালু যেতে চাচ্ছে না, বারবার হাম্বা হাম্বা করছে। এক সময় লালু এতগুলো মানুষের সাথে পেরে উঠে না। বাধ্য হয়েই আঘাতের তাড়নায় তাদের সাথে পথ ধরতে হয় লালুর।
.
ফাতেমা মাটিতে শুয়ে পরেছে, দু পা দাপিয়ে কান্না করছে, তার কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস, তার সাথে জয়নালের মন। শত হলেও মা মরা মেয়ে। হাত তুলবে তো দূরের কথা 'মা' ছাড়া কখনো কথাই বলেনা জয়নাল। অথচ আজ সেই মেয়ের গায়েই হাত। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
.
জয়নাল মেয়েকে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ফাতেমা চিকিৎসা করে কেঁদেই চলছে। জয়নাল মেয়েকে বুকে টেনে নেয় আর বুঝানোর চেষ্টা করে।
.
- মারে আমরা গরিব মানুষ কি করুম ক। গুরু না বেঁচলে যে আমাগো পেটে ভাত জুটবো না। তোরে আবার একটা বাছুর কিইনা দিমুনে।
.
- কোন কিছু লাগবো না আমার, লালুরে আইনাদে।
.
রাগে বাপেরে মারতে আসে ফাতেমা। হাত ছোড়াছুড়ি করে। জয়নাল হাত দুটো শক্ত করে ধরে, আবার বুকের মাঝে আগলে রাখে ।
.
- এমন করিছ না মা, তোর মার কসম লাগে শান্ত হ।
.
মায়ের কথা বলতেই ফাতেমা চুপ হয়ে গেছে। নদীতে বাতাস না থাকলে যেমন পানি নিটল হয়ে যায় তেমনি হঠাৎ করেই ফাতেমা শীতল হয়ে গেছে। বাবার বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে, ঘরে গিয়ে হাঁটুতে মাথা রেখে কষ্টের জল বিসর্জন দিচ্ছে।
.
সারাদিন ফাতেমা কিছু খায়নি। জয়নাল বিকেলে হাঁট থেকে নতুন জামা এনে দিয়েছে ফাতেমাকে, কিন্তু সে, সেদিকে তাকিয়েও দেখেনি। রাতে অনেক জোর করার পরেও ফাতেমার মুখে খাবার তুলে দিতে পারেনি ব্যর্থ বাবা জয়নাল। রাত কেটে গেছে দুটি হৃদয়ের কষ্টের দহনে, অথচ কাল ঈদ।
,,,
ফাতেমাদের বাড়ির উঠোনে মানুষের কোলাহল, তার সাথে লালুর হাম্বা হাম্বা ডাক। লালুর ডাক শুনে ফাতেমা হকচকিয়ে গেছে। লালুকে পাশের গ্রামেই বিক্রি করা হয়েছিল কিন্তু কোরবানির ঠিক আগ মুহূর্তে দড়ি ছিঁড়ে এখানে চলে এসেছে, তার সাথে সেখানকার মানুষজনও দৌড়ে চলে এসেছে ফাতেমাদের বাড়ি। কিন্তু লালুকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। ফড়িং এর মতো শুধু লাফাচ্ছে আর লাফাচ্ছে ।
.
ফাতামাকে দেখে লালু থেমে গেছে। সে কাছে যেতেই লালু ফাতেমার বুকে আশ্রয় চাচ্ছে। ফাতেমা লালুর গলায় হাত দিয়ে আদর করে তারপর লালুর মাথাটা নিজের বুকের সাথে মেশিয়ে কিছু একটা সান্ত্বনা দেয় কিন্তু সেই সান্ত্বনায় মিশে থাকে ফাতেমার কষ্টের নোনা জল। যে জলের ভাষা লালু আর ফাতেমা ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। এখন লালু একদম থেমে গেছ কোন সারা শব্দ নেই।
.
এবার ফাতেমা যে কাজটি করে সেটা দেখার জন্য ফাতেমার বাবা জয়নাল বা অন্য সবাই প্রস্তুত ছিল না। লালুর গলায় বাধা দড়ি হাতে নিয়ে ফাতেমা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটছে। উদ্দেশ্য যারা গরু কিনেছে তাদের বাড়িতে লালুকে পৌঁছে দেওয়া । সবাই বিস্মৃত, কারণ যে ফাতেমা লালুর জন্য মাটিতে পা দাবরিয়ে কেঁদেছে সে এখন লালুকে ক্রেতাদের বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে।
.
লালুর পা গুলো বাঁধা হয়েছে, লালু হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে। কিছুক্ষণের ভেতর হয়তো লালুকে কোরবানি দেওয়া হবে। ফাতেমা পেছন থেকে স্পষ্ট শুনতে পারছে লালুর ডাক, তার কিছুক্ষণ পরেই জবাই করার গো গো শব্দ। ফাতেমা দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরেছে, চোখ দিয়ে অশ্রুর নাহল ছুটেছে। সে আর সহ্য করতে পারছে না। খুব জোরে দৌড়াচ্ছে ফাতেমা, সে লালুর আওয়াজ শুনতে চায়না, দেখতে চায়না লালুর লাল রক্ত।
.
হ্যাঁ এটাই আত্ম ত্যাগের মহিমা । এটাই ভালোবাসার বলিদান, এটাই সত্যিকারের কোরবানির উদাহরণ ।
লিখেছেন : Azad Abul Kalam